blog-thumb
Post By : Nahid Limu Date : October 2, 2025

উত্তরবঙ্গের চা বাগানসমূহে জেসিড বা গ্রীন ফ্লাই, ডাই ব্যাক বা আগা মরা রোগের প্রাদুর্ভাব ও করণীয়

ইদানিং পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানে জেসিড বা গ্রীন ফ্লাই, ডাই ব্যাক বা আগা মরা ও গ্রে ব্লাইট রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে চাষিরা উদ্বিগ্ন হচ্ছে। চায়ের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। পঞ্চগড়ের সরবরাহকৃত চায়ের পাতার নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, চায়ের পাতায় থ্রিপ্স, জেসিড, ডাই ব্যাক এর আক্রমন লক্ষ্য করা গেছে। উক্ত পোকা দুটির মাধ্যমে চা গাছের ছত্রাকের স্পোর ছড়াতে পারে। পরবর্তীতে সেকেন্ডারী ইনফেকশন হিসেবে ছত্রাকঘটিত রোগ রিম ব্লাইট, ডাই ব্যাক ও গ্রে ব্লাইটের আক্রমণ দেখা দিতে পারে।

#১
থ্রিপ্স অতি ক্ষুদ্র বাদামী রংয়ের পোকা। নার্সারী ও অপরিনত চায়ের অন্যতম অনিষ্টকারী কীট। নার্সারী ও স্কিফ এলাকায় আক্রমন বেশী পরিলক্ষিত হয়। চা আবাদী এলাকায় ছাঁটাই উত্তর নতুন কিশলয়ে আক্রমন পরিলক্ষিত হয়। রস শোষণের ফলে পাতার উপরিভাগের মধ্যশিরার দু’পাশ্বে দুটি লম্বা শোষণ রেখা দেখা যায়।

চা আবাদীর আরও একটি অনিষ্টকারী পোকা জেসিড যা নার্সারী ও অপরিনত চায়ের অন্যতম ক্ষতিকারক কীট। এটি সবুজ মাছি বা গ্রীন ফ্লাই নামেও পরিচিত। সাধারণত চা আবাদী এলাকায় ছাঁটাই উত্তর নতুন কিশলয়ে আক্রমন পরিলক্ষিত হয়। এরা চায়ের পাতার রস শুষে নেয়। আক্রান্ত পাতা নৌকাকৃতি ধারন করে ও কিনারা শুকিয়ে যায়। কিশলয়ের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও পাতা কুকড়িয়ে যায়। উভয় পোকা দমনে আক্রান্ত সেকশনে পর্যাপ্ত ছায়াপ্রদানকারী গাছ লাগাতে হবে। সেকশন অবশ্যই আগাছামুক্ত রাখতে হবে। আবাদীতে প্লাকিং রাউন্ড অবশ্যই ৭-৮ দিন অনুসরণ করতে হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (আইপিএম) আলোকে চা আবাদীর সেকশনে সোলার আলোক ফাঁদ বা আঠালো হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে।

বায়োপেস্টিসাইড হিসেবে হেক্টর প্রতি ১.২৫ লিটার হারে বায়ো-চমক (Celastrus angulatus) ব্যবহার করা যেতে পারে।

এন্টোমোপ্যাথোজেন হিসেবে হেক্টর প্রতি ২.৫ কেজি হারে ধামান (Beauveria bassiana) ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়াও রাসায়নিক দমন হিসেবে হেক্টর প্রতি ৫০০ গ্রাম হারে অটোমিডা ৭০ ডব্লিউডিজি (ইমিডাক্লোপ্রিড+এসিফেট) অথবা ২৫০ গ্রাম হারে ওয়ারিয়র ৭০ ডব্লিউডিজি (পাইমেট্রোজিন+ডাইনটিফুরান) ৫০০ লি. পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন অন্তর ২ বার স্প্রে করতে হবে। কচি ডগা ও কচি পাতার নিচে স্প্রে করতে হবে।


#২

বর্তমান সময়ে পঞ্চগড় অঞ্চলের আরেকটি সিরিয়াস রোগ হলো ডাই ব্যাক বা আগা মরা রোগ। সাধারনত: সব বয়সের চা গাছ এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে নার্সারী ও মাদার বুশ জাতীয় চা গাছকে আক্রমণ করলে ক্ষতির পরিমান বেশী পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। চারা বা অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক গাছকে আক্রমণ করলে অনেক সময় গাছ বাঁচানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় এবং মাদারবুশকে আক্রমণ করলে কাটিং এর পরিমান কমে যায়। Colletotrichum gloesporoides নামক ছত্রাক দ্বারা এই রোগ সংঘঠিত হয়। জুলাই-অক্টোবর মাসে মাঠে এ রোগ বেশী দেখা যায়। প্রবল বায়ু প্রবাহ, বৃষ্টিপাত, শিশির, কীটপতঙ্গ ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার লাভ করে। মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমান সারের অভাব, জলাবদ্ধতা, অত্যাধিক ছায়া, আর্দ্র ও স্যাঁতস্যতে আবহাওয়া এ রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য সহায়ক। এ রোগের আক্রমনে প্রথমে কচি ডগায় ছোট ছোট বাদামী দাগ পড়ে। আস্তে আস্তে দাগগুলো ক্রমশ বড় হতে থাকে ও হলুদাভ হয়। পরবর্তীতে এই দাগ আক্রমনের স্থান থেকে উপর ও নিচে উভয় দিকে বর্ধিত হয়ে ধুসর বাদামী বা কালো রং ধারণ করে। এ কালো দাগ ক্রমশ আক্রান্ত ডালের নিচের দিকে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাড়ন্ত মুকুল (Auxillary bud) প্রস্ফুটিত হতে পারে না। ফলে বাড়ন্ত মুকুল (Auxillary bud), পাতাসমূহ ও ডাল-পালা আস্তে আস্তে সজিবতা হারিয়ে শুকিয়ে যায় এবং মারা যায়। গাছের বা ডালের আগা হতে গোড়ার দিকে ক্রমশ আক্রান্ত ডাল-পালাগুলো মারা যায় বিধায় এ রোগকে ডাই ব্যাক বা আগা মরা রোগ বলা হয়।


এ রোগ প্রতিকারের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক ব্যবস্থা না নিলে রোগের প্রাদুর্ভাব দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। রোগের আক্রমণ দেখা যাওয়া মাত্রই রোগ সংঘঠিত হওয়ার অনুকূল নিয়ামকসমূহের (ফ্যাক্টরগুলো) জরুরী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

  • রোগাক্রমণ অল্প এলাকায় হলে এবং সম্ভব হলে আক্রান্ত অংশের সামান্য নিচে ধারালো চাকু দিয়ে কেটে রোগাক্রান্ত অংশটি অপসারণ পূর্বক প্রতি লিটার পানিতে ১.০ গ্রাম পরিমান কার্বেন্ডাজিম+ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক (ম্যানসার/কম্প্যানিয়ন ৭৫ ডব্লিউপি) মিশিয়ে পুরো গাছে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
  • আক্রান্ত এলাকা বড় হলে হেক্টর প্রতি ২.৮ কেজি হারে কুপ্রাভিট ৫০ ডব্লিউপি (কপার অক্সিক্লোরাইড) ছত্রাকনাশক অথবা ৭৫০ গ্রাম হারে নোইন ৫০ ডব্লিউপি (কার্বেন্ডাজিম) অথবা ১.০ লিটার হারে এমিস্টার টপ ৩২.৫ এসসি (এজক্সিস্ট্রবিন+ডাইফেনোকোনাজোল) অথবা ২.০ কেজি হারে এনট্রাকল ৭০ ডব্লিউপি (প্রপিনেব) ১০০০ লিটার পানিতে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
  • সফলভাবে এ রোগ দমনার্থে ১৫ দিন পরপর আরও ২ বার উক্ত ঔষধ স্প্রে করতে হবে।


মোহাম্মদ শামীম আল মামুনের কাছ থেকে সংগৃহীত, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বিজ্ঞানী